😢 “তিন গোয়েন্দা” খ্যাত লেখক রকিব হাসান — শিল্পজগতের এক মন্থর বিদায়

 💔 তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান আর নেই: বিদায় এক কিংবদন্তি লেখকের

বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন রকিব হাসান। তার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গিয়েছিল।

বাংলা সাহিত্যের কিশোর পাঠকদের হৃদয়ে যে নাম চিরকাল জীবন্ত থাকবে, তিনি রকিব হাসান — “তিন গোয়েন্দা” সিরিজের স্রষ্টা, যিনি কিশোর বয়সের হাজারো পাঠকের কল্পনা, রহস্য ও অভিযানের জগৎ গড়ে তুলেছিলেন।

আজ বুধবার বিকেলে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (বয়স ৭৫ বছর)। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি; কিডনির সমস্যা, ডায়ালাইসিস চলার সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মূর, যিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের পুত্রবধূ। তাঁর ভাষায়, “বাংলা কিশোর সাহিত্যের এক অনন্য অধ্যায় আজ শেষ হয়ে গেল।”

---

✍️ সাহিত্যজীবনের শুরু ও লেখক হয়ে ওঠা

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব কাটে ফেনীতে। পড়াশোনার পর বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবন তাঁর পছন্দ হয়নি। নিজের ভাষায়,

“আমি স্বাধীন টাইপের মানুষ। স্যার বলা, নিয়ম মেনে অফিস করা — এসব আমার দ্বারা হতো না।”

অবশেষে তিনি লেখালেখিকেই বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে। প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে, ছদ্মনামে। নিজের নামে প্রথম প্রকাশিত বই ছিল অনুবাদগ্রন্থ “ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা”, যা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।

---

📚 তিন গোয়েন্দা: এক প্রজন্মের কৈশোরসঙ্গী

ছবি: সংগৃহীত

১৯৮৫ সালে প্রকাশ পায় তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি — “তিন গোয়েন্দা”।
রবিন মিলফোর্ড, কিশোর পাশা ও মুসা আমান — এই তিন চরিত্র শুধু বইয়ের পাতায় নয়, পাঠকের জীবনে বন্ধু হয়ে উঠেছিল। রকিব হাসানের কলমে ক্যালিফোর্নিয়ার রকি বিচের দৃশ্য যেমন বাস্তব মনে হতো, তেমনি তিন কিশোরের সাহস, মেধা ও বন্ধুত্বে ছিল জীবনের রঙ।

তিন গোয়েন্দা সিরিজে তিনি লিখেছেন ১৬০টি বই, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিশোর সিরিজ হিসেবে স্বীকৃত।
এছাড়া তিনি লিখেছেন গোয়েন্দা রাজু, তিন বন্ধু, রোমহর্ষক সিরিজ, কিশোর মুসা রবিন ইত্যাদি। তাঁর ছদ্মনামগুলোর মধ্যে ছিল জাফর চৌধুরী, আবু সাঈদ প্রভৃতি।

---

🧩 “রকিব হাসান” নামের পেছনের গল্প

রকিব হাসানের পূর্ণ নাম ছিল আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব। নামটি বড় ও জটিল হওয়ায় কাজী আনোয়ার হোসেন এবং শিল্পী শাহাদত চৌধুরীর পরামর্শে তাঁর নাম রাখা হয় “রকিব হাসান” — আবদুর রকিবের “রকিব” আর ডাকনাম “হাসান” মিলিয়ে।

এই নামেই তিনি হয়ে ওঠেন সেবা প্রকাশনীর ইতিহাসের অন্যতম সফল লেখক।
প্রথম অনুবাদগ্রন্থ “জঙ্গল” (কেনেথ অ্যান্ডারসনের লেখা) প্রকাশের পর থেকেই পাঠক মহলে তাঁর বইয়ের চাহিদা আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে।

---

📖 অনুবাদ, ছদ্মনাম ও বৈচিত্র্য

লেখক হিসেবে তিনি শুধু নিজস্ব কাহিনি নয়, বরং বহু বিশ্বখ্যাত সাহিত্যকর্ম অনুবাদ করেছেন।
তার মধ্যে রয়েছে এরিক ফন দানিকেন, ফার্লে মোয়াট, জেরাল্ড ডুরেল, এডগার রাইস বারোজের টারজান সিরিজ, এমনকি অ্যারাবিয়ান নাইটস–এর অনুবাদ।

নিজের ভাষায় তিনি বলেছিলেন—

“আমি এত বই লিখেছি যে এখন আর গুনে বলতে পারি না, মনে হয় চারশোর কাছাকাছি হবে।”

---

💬 ব্যক্তিজীবন ও মনন

রকিব হাসান ছিলেন অতি সরল ও আত্মসমালোচক মানুষ।
এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—

“এই বয়সে অনেকেই বৃদ্ধাশ্রমে, কিন্তু আমি নিজের ঠিকানা তৈরি করে ভালো আছি। লিখেছি অনেক, এত জনপ্রিয় হবো ভাবিনি।”

লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও পরিশ্রমী। অসুস্থতা সত্ত্বেও শেষ বয়স পর্যন্ত বই আর পাঠকের খোঁজ রাখতেন। চোখের দুর্বলতা, হাত কাঁপা— এসব বাধা তাঁকে থামাতে পারেনি।

---

🕊️ শেষ সময় ও চিরবিদায়

রকিব হাসান ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন।
আজ (বুধবার) বিকেলে ডায়ালাইসিস চলাকালীন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে কিশোর পাঠক সমাজে তাঁর মৃত্যুতে নেমে এসেছে গভীর শোক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারো পাঠক লিখছেন —

“রবিন, কিশোর, মুসা আজ অনাথ হয়ে গেল।”

---

🌹 শ্রদ্ধাঞ্জলি

রকিব হাসান শুধু একজন লেখক ছিলেন না, ছিলেন এক প্রজন্মের কল্পনাশিল্পী।
বাংলার কিশোর পাঠক সমাজের কাছে তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি বই হাতে কিশোর বয়সের প্রতিটি বিকেলকে করে তুলেছিলেন রহস্য, বন্ধুত্ব ও সাহসে ভরা।

তাঁর কলম থেমে গেছে, কিন্তু তাঁর গল্প অমর থাকবে —
রবিন, কিশোর, মুসা আজও রকিব হাসানের নাম উচ্চারণে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

"তিন গোয়েন্দা আজ চুপচাপ বসে আছে। তাদের স্রষ্টা চলে গেছেন, কিন্তু গল্পগুলো এখনো বেঁচে আছে প্রতিটি পাঠকের মনে।"